তাওহিদ ( التَّوْحِيدُ ) (পাঠ ১)

সপ্তম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - ইসলাম শিক্ষা আকাইদ | - | NCTB BOOK
127
127

তাওহিদ শব্দের অর্থ একত্ববাদ। মহান আল্লাহকে এক ও অদ্বিতীয় সত্তা হিসেবে বিশ্বাস করার নামই হলো তাওহিদ। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা এক। তার কোনো শরিক নেই। তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ। তিনিই আমাদের রক্ষক, সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও রিজিকদাতা। তিনি অনাদি ও অনন্ত। তার সমকক্ষ বা সমতুল্য কিছুই নেই। তিনিই একমাত্র মাবুদ। সকল প্রশংসা ও ইবাদত একমাত্র তারই প্রাপ্য। মনে প্রাণে এরূপ বিশ্বাস করাকেই তাওহিদ বলা হয়।

তাওহিদের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

আকাইদের সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান বিষয় হলো তাওহিদ। তাওহিদে বিশ্বাসের মাধ্যমেই মানুষ ইমান ও ইসলামে প্রবেশ করে। তাওহিদে বা একত্ববাদে বিশ্বাসের পর আকাইদের অন্যান্য বিষয় বিশ্বাস করতে হয়। তাওহিদে বিশ্বাস মানুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মানবজাতির হিদায়াতের জন্য দুনিয়াতে অনেক নবি-রাসুল আগমন করেছেন। তাঁরা সকলেই তাওহিদের দিকে মানুষকে আহ্বান করেছেন। তাঁদের সকলের দাওয়াতের মূল বাণী ছিল 'লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু' لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ অর্থাৎ 'আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ বা মাবুদ নেই'। এমন কোনো নবি ছিলেন না যিনি তাওহিদের কথা বলেন নি। বরং সকল নবি-রাসুলই তাওহিদের শিক্ষা প্রচার করেছেন। ইসলামের সকল বিধি-বিধান তাওহিদের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাওহিদের পরিপন্থী কোনো বিধান ইসলামে নেই। সালাত, যাকাত, সাওম, হজ সকল ইবাদতই এক আল্লাহর জন্য করতে হয়। কোনো কিছু চাইতে হলেও এক আল্লাহর নিকট চাইতে হয়। এটাই ইসলামের শিক্ষা। অতএব, ইসলামে তাওহিদের গুরুত্ব অপরিসীম।

তাওহিদে বিশ্বাস মানুষকে দুনিয়াতে ও আখিরাতে সফলতা এনে দেয়। কেননা তাওহিদ মানুষকে আল্লাহর পরিচয় দান করে। মানুষ আল্লাহ তায়ালার ক্ষমতা ও গুণাবলি জানতে পারে। দুনিয়ার কাজকর্মের জন্য মানুষকে পরকালে আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করতে হবে-এ শিক্ষা তাওহিদের মাধ্যমেই লাভ করা যায়। এ শিক্ষার দ্বারা মানুষ অন্যায় কাজ হতে বিরত থাকলে এর ফলে সে আখিরাতে সফলতা লাভ করবে।
দুনিয়ার জীবনেও তাওহিদে বিশ্বাসের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। তাওহিদে বিশ্বাসীগণ শুধু আল্লাহ তায়ালার সামনে মাথা নত করে। অন্য কারো সামনে সে মাথা নত করে না। পক্ষান্তরে, তাওহিদে বিশ্বাস না করলে মানুষ বিপথগামী হয়ে যায়। সে গাছপালা, পশু-পাখি, চন্দ্র-সূর্য ইত্যাদির নিকট মাথা নত করে। নানা মূর্তির পূজা করতে থাকে। ফলে মানুষের আত্মমর্যাদা বিনষ্ট হয়। তাওহিদে বিশ্বাস মানুষের মধ্যে আত্মসম্মান ও আত্মসচেতনতা জাগিয়ে তোলে।

তাওহিদ বা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস মানুষকে এক জাতিত্ব বোধ এনে দেয়। ফলে মানুষ পরস্পর ভ্রাতৃত্ব ও সহমর্মিতায় উদ্বুদ্ধ হয়। পক্ষন্তরে, শিরক বা বহু উপাস্যের বিশ্বাস মানুষকে বহুদল ও গোষ্ঠিতে বিভক্ত করে দেয়। এক মানবজাতির বিভাজন পরিণতিতে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও হানাহানির কারণ হয়। এতে শান্তি ও মানবতা বিপর্যস্ত হয়। তাওহিদে বিশ্বাস মানুষকে এক আল্লাহ তায়ালার প্রতি নির্ভরশীল করে। ফলে বিপদে আপদে, দুঃখ-কষ্টে মানুষ হতাশ বা নিরাশ হয় না বরং আল্লাহর উপর ভরসা রেখে পূর্ণোদ্যমে কাজ করতে থাকে এবং সাফল্য লাভ করে। এভাবে তাওহিদে বিশ্বাস মানুষকে দুনিয়ার জীবনে সুখ-শান্তি ও সফলতার দুয়ার খুলে দেয়।

কতো বিশাল এ বিশ্বজগৎ। আমাদের পৃথিবী এর সামান্য অংশমাত্র। বড় বড় গ্রহ, নক্ষত্র, ছায়াপথ, নীহারিকা, গ্যালাক্সি এ বিশ্বজগতে বিরাজমান। এগুলোর প্রত্যেকটিই সুশৃঙ্খলভাবে ঘুরছে। কোনোটি এর নির্ধারিত নিয়মের বাইরে যাচ্ছে না।

কে দিলেন এই নিয়ম? আমাদের পৃথিবী কতো সুন্দর। এতে রয়েছে বিশাল আকাশ, বিস্তৃত মাঠ, বড় বড় পাহাড়-পর্বত, প্রবাহমান নদী-নালা, সাগর-মহাসাগর। এ সবকিছুই আপনা আপনি সৃষ্টি হয় নি। কে এসবের সৃষ্টিকর্তা?

প্রাকৃতিক দৃশ্য

ফল খেতে আমরা সবাই ভালোবাসি। আমগাছে আম হয়, জামগাছে জাম। আমরা কি কখনো কাঁঠাল গাছে আম কিংবা তরমুজ ধরতে দেখেছি? কেউই দেখিনি। কারণ কাঁঠালগাছে কাঁঠাল ছাড়া অন্যকোনো ফল হয় না। আমাদের চারপাশে রয়েছে নানারকম পশু-পাখি। কাক আমাদের অতিপরিচিত পাখি। কাক সবসময় কা কা করেই ডাকে। কাক কোনো দিন কোকিলের মতো ডাকে না। আবার গরু, ছাগল, কুকুর, বিড়াল সবাই নিজ নিজ স্বরেই ডাকাডাকি করে। আমরা কি কখনো চিন্তা করেছি কেন এমন হয়? কেন এক পশু আরেক পশুর স্বরে ডাকে না? গাছের ফল-ফসল, পশু-পাখির আচার-ব্যবহার- এসব কে নিয়ন্ত্রণ করেন?

বস্তুত আল্লাহ তায়ালাই এই সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা ও নিয়ন্তা। মহাজগতের নিয়ম-শৃঙ্খলা তারই দান। পৃথিবীর সকল কিছুর স্রষ্টাও তিনিই। আর পশু-পাখি, গাছপালাসহ সবকিছুর নিয়ন্ত্রকও তিনি। তিনিই সবকিছু করেন। বরং তিনি যা ইচ্ছা করেন তা-ই হয়। এসব কিছুতে যদি একের বেশি নিয়ন্তা থাকত, তবে নানারকম বিশৃঙ্খলা দেখা দিত। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন-

لَوْ كَانَ فِيهِمَا أَلِهَةٌ إِلَّا اللَّهُ لَفَسَدَتَا جِ

অর্থ: 'যদি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে, আল্লাহ ব্যতীত বহু ইলাহ থাকত, তবে উভয়েই ধ্বংস হয়ে যেত।' (সুরা আল-আম্বিয়া, আয়াত ২২)

একটু চিন্তা করলেই আমরা বিষয়টি বুঝতে পারব। যেমন মহাজগতের সৃষ্টিকর্তা ও বিধানদাতা যদি একাধিক হতেন, তাহলে মহাজগৎ এত সুশৃঙ্খলভাবে চলত না। একজন স্রষ্টা চাইতেন সূর্য পূর্ব দিকে উঠুক। আরেকজন চাইতেন পশ্চিম দিকে। আবার অন্যজন দক্ষিণ বা উত্তর দিকে সূর্যকে উদিত করতে চাইতেন। ফলে এক চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিত।

এমনিভাবে আমগাছে আম না হয়ে কোনো কোনো সময় কাঁঠাল, জাম ইত্যাদিও হতে পারত। এতে আমরা বেশ অসুবিধায় পড়তাম। বস্তুত একাধিক স্রষ্টা বা নিয়ন্ত্রক থাকলে বিশ্বজগতের সুন্দর সুশৃঙ্খল অবস্থা বিনষ্ট হয়ে যেত। আল-কুরআনের অন্য এক আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন-

وَمَا كَانَ مَعَهُ مِنْ إِلَهِ إِذًا لَّذَهَبَ كُلُّ الهِ بِمَا خَلَقَ وَلَعَلَا بَعْضُهُمْ عَلَى بَعْضٍ

অর্থ: "আর তার (আল্লাহর) সাথে কোনো ইলাহ নেই। যদি তা থাকত, তবে প্রত্যেক ইলাহ নিজ নিজ সৃষ্টিকে নিয়ে পৃথক হয়ে যেত এবং একে অপরের উপর প্রাধান্য বিস্তার করত।" (সুরা আল-মু'মিনূন, আয়াত ৯১ )

এ আয়াতেও তাওহিদ বা একত্ববাদের তাৎপর্য সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। নিচের উদাহরণের মাধ্যমে আমরা তা বুঝতে পারি। একাধিক স্রষ্টা থাকলে তারা তাঁদের সৃষ্টিকে নিয়ে আলাদা হয়ে যেতেন। যেমন আগুনের স্রষ্টা আগুন নিয়ে পৃথক হয়ে পড়তেন। অতঃপর সমস্ত কিছুকে আগুন দ্বারা জ্বালিয়ে দিয়ে তার নিজ ক্ষমতার প্রকাশ করতেন। তেমনি মহাসাগরের স্রষ্টা সারা পৃথিবী তার সৃষ্টি দ্বারা ডুবিয়ে দিতে চাইতেন। এভাবে স্রষ্টাগণ নিজ নিজ সৃষ্টি দ্বারা অন্যের উপর বিজয়ী হতে চাইতেন। ফলে আমাদের অস্তিত্বই বিলুপ্ত হয়ে যেত। পৃথিবীর সকল কিছুই ধ্বংস হয়ে যেত।

এসব বর্ণনা এ কথাই প্রমাণ করে যে ইলাহ মাত্র একজনই। আর তিনি হলেন আল্লাহ তায়ালা। তিনি সকল কিছুর স্রষ্টা, নিয়ন্ত্রক ও পালনকর্তা। তার হুকুম ও নিয়মেই সবকিছু পরিচালিত হয়। কোনো সৃষ্টিই এ নিয়মের ব্যতিক্রম করতে পারে না। এসব কাজে তিনি একক ও অদ্বিতীয়। আন্তরিকভাবে এরূপ বিশ্বাসের নামই তাওহিদ বা একত্ববাদ।
আমরা তাওহিদের পরিচয় জানব। এতে বিশ্বাস স্থাপন করব। এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য উপলব্ধি করে প্রকৃত ইমানদার হবো।

একক কাজ: তাওহিদের তাৎপর্য লিখবে এবং প্রত্যেকে তার পাশের বন্ধুকে দেখাবে।
বাড়ির কাজ: তাওহিদে বিশ্বাসের ফলে ব্যক্তির জীবন ও কর্মে কী কী পরিবর্তন আসতে পারে তার একটি তালিকা তৈরি করবে।
Content added By
Promotion